শীতকাল মানেই হরেক রকম সবজির পসরা সাজিয়ে প্রকৃতির আগমন।শীতকালে বাজারে নানা ধরণের শীতকালীন সবজি পাওয়া যায়।
এর মধ্যে বাঁধাকপি হলো এমনি একটি শীতকালীন সবজি যা শীতকালেই প্রচুর পরিমাণে জন্মায়। বাঁধাকপির তরকারি ও গরম ভাত শীত কালে স্বাদে এক
লোভনীয় মাত্রা যোগ করে। সত্যি, শুধু নামে নয়, বাঁধাকপির পরিচয় আসলে গুণে।এ পুষ্টিগুণও অন্যান্য শীতকালীন সবজীর তুলায় অনেক বেশি।
চীন, মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপ আর মেসোপটেমিয়ায় বাঁধাকপি চাষের ইতিহাস মেলে, প্রায় চার হাজার বছর আগে থেকেই যার শুরু ।
বাঁধাকপির উপকারিতা অনেকভাবেই বাঁধাকপির স্বাদ নিতে পারেন। সবজি হিসেবে ভাজি করে তো খেতেই পারেন, তাছাড়া বাঁধাকপি স্যুপ,
বাঁধাকপির সালাদ ইত্যাদি তো আছেই। আসুন স্বাস্থ্যকর এই সবজি, বাঁধাকপির কিছু গুণের কথা জেনে নেই।
ভিটামিন-সি এর উৎস
কাঁচা, রান্না করে অথবা শুকিয়ে সালাদের মশলা হিসেবেও বাঁধাকপি খেতে পারেন। এর পুষ্টিগুণ নির্ভর করে, এটি কোন পদ্ধতিতে খাওয়া হচ্ছে তার উপর। এক কাপ আধা সেদ্ধ বাঁধাকপিতে পাওয়া যাবে, আমাদের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ভিটামিন সি এর তিন ভাগের এক ভাগ।
ইমিউন সিস্টেমের জন্য উপকারি
এতে ম্যাঙ্গানিজ, ডায়াটারি ফাইবার, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি ৬, ভিটামিন এ থাকায় শরীরের ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হয় এবং ছোট-খাটো রোগবালাইকে ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয় না।
মস্তিষ্কের বিকাশে বাঁধাকপি
প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন কে থাকায় এই সবজিটি নিয়মিত খেলে মস্তিষ্কের বিকাশ তরান্বিত হয়। সেই সাথে নার্ভের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।
হজমে সহায়তা করে
এই সবজিতে থাকা ফাইবার হজমে সহায়তা করার পাশাপাশি পাকস্থলী ও অন্ত্রের ভেতরের অংশকে শক্তিশালী করে এবং একইসাথে পাকস্থলীর আলসারও নিরাময় করে।
ক্যান্সার প্রতিরোধ করে
বাঁধাকপিতে উপস্থিত ভিটামিন এ, ভিটামিন সি সহ আরও অনেক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান, দেহে ক্যান্সারের কোষের বিস্তার রোধ করে। যা কোলন, স্তন ক্যানসার এবং প্রোস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়তা করে। বাঁধাকপিতে আরো থাকছে অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট। এর ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস কোষকে সজীব রাখে, কোষের প্রদাহ দূর করে এবং ফোলা কমায়। অনেক ক্ষেত্রেই ক্যানসার ছাড়াও হার্টের অসুখ, ডায়বেটিস প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে বলে মনে করা হয়।
দেহের ওজন কমায়
বাঁধাকপিতে রয়েছে লো ফ্যাট এবং উচ্চ ফাইবার। আপনি যদি ডায়েটের মধ্যে থাকেন, তবে প্রতিদিনকার সবজির তালিকায় বাঁধাকপি রাখতে পারেন, যা আপনার ওজন দ্রুত কমাতে সাহায্য করবে।
দেহের বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে সাহায্য করে
এতে উপস্থিত প্রচুর পরিমাণের ভিটামিন সি ও সালফার দেহের বিষাক্ত পদার্থ ইউরিক অ্যাসিড দূর করে থাকে। যার ফলে বাত, গেঁট বাত, স্কিন ইনফেকশন ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকে শরীর।
বলিরেখা দূর করে
নিয়মিত বাঁধাকপি খেলে ত্বকে সহজে বলিরেখা দেখা যায় না। এতে থাকা ভিটামিন সি ত্বকের তারুণ্য ধরে রেখে দীর্ঘদিন বয়সের ছাপ থেকে দেয় মুক্তি। তাছাড়া এর ভিটামিন এ এবং ভিটামিন ডি উপাদান আপনার ত্বক পরিষ্কার করতে এবং ত্বককে আলট্রা ভায়েলেট রশ্মির হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে।
মাথা ব্যথা দূর করে
বাধাঁকপির পাতা দিয়ে তৈরি একধরণের উষ্ণ পানীয় আপনার মাথা ব্যথা দূর করতে সাহায্য করবে। বাঁধাকপি পাতা কুচি করে একটি কাপড়ে পেঁচিয়ে সেটি দিয়ে আপনার কপালে ভাপ দিন। একই সাথে কাঁচা বাঁধাকপি জুস প্রতিদিন পানের অভ্যাস করুন। এটি ক্রনিক মাথাব্যথা দূর করতে বেশ কার্যকরী টনিক।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
বাঁধাকপি উচ্চ আঁশযুক্ত সবজি এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহয়তা করে। আপনার কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকলে নিয়মিত বাঁধাকপি খেতে পারেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন।
আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে বাঁধাকপি হয়। তাই পুষ্টির জন্য বেশি বেশি খেতে পারি এই সবজি। শীতকালজুড়ে রাখতে পারি সালাদে। আর এই বাঁধাকপি দিয়ে নানা ধরনের পদও রান্না হয়ে থাকে।
কয়েকটি ভিন্ন স্বাদের বাঁধাকপির রেসিপি

আসতে শীত! আর প্রতিবারের মতো এবারের শীতেও জলের দরে বিক্রি করা হবে বাধা কপি! শীত এলেই বাজারগুলোতে যেন হরেক রকমের সবজিতে ভরে যায়, আর এমনিতেও সেই সময় ক্রেতাদের মূল আকর্ষণ থাকে বাঁধাকপি!
খুব সাধারণ, তবে সুস্বাদু বাঁধাকপির তরকারি রান্না করতে পারেন তো? আপনার কাজটি সহজ করতেই শীতকালীন সবজির কথা মাথায় রেখে আপনার জন্য নিয়ে আসলাম বাঁধাকপির তরকারি রেসিপি!
তো চলুন দেখে নেওয়া যাক,বাঁধাকপির তরকারি তৈরীর বেসিক একটা রেসিপিঃ
বাঁধাকপির তরকারি এর জন্য যা যা প্রয়োজন পড়বে-
- বাঁধাকপি কুচি 6 কাপ
- আদা বাটা 2 চামচ
- একটা আলু ডুমো করে কাটা
- জিরে গুঁড়ো 1 চামচ
- গোটা জিরা 1 চামচ
- তেল চার চামচ
- নূন পরিমাণমতো
- কাঁচা লঙ্কা দুটো
- তেজপাতা দুটো
- শুকনো লঙ্কা একটা
- টমেটো কুচি 4 চামচ
- ধনেপাতা কুচি 4 চামচ
আরো পড়ুনঃ
- চালতার আচার রেসিপি- চালতার আচার হবে এখন বাড়িতেই!
- এই শীতে ফুলকপির তরকারি এর মজাদার রেসিপি দেখে নিন!
- দই পটল রেসিপি-একদম ভিন্ন রকমের একটি রেসিপি!
- ডালিয়া রেসিপি – ভিন্নধর্মী একটি খিচুরী রেসিপি!
- মজাদার সেমাই রান্না করুন বাসায় !
বাঁধাকপির তরকারি প্রস্তুত প্রণালী
প্রথমে একটি কড়াইয়ে কিছুটা তেল ঢেলে নিন। কিছুটা তেল গরম করে নিয়ে তার ভেতরে ভালো করে আলুগুলো ভেজে নিন। ভাজার সময় চাইলে একদম ডিপ ফ্রাই করতে পারেন,তবে এতে করে অনেকের কাছে ভালো লাগতেও পারে।
অনেকের কাছে নাও লাগতে পারে। নির্ভর করবে আপনার জ্বিভের চয়েজের উপর। এর পর ওই তেলেই কিছুটা গোটা জিতে আর শুকনো লঙ্কা,সাথে দুই একটা তেজপাতা এবং কিছুটা পাচফোড়োন যোগ করে নিন।
কিছুটা জিরে গুড়ো দিয়ে ভালো ভাবে মশলাটাকে কষিয়ে নিতে হবে। আর হ্যাঁ! যতো ভালো ভাবে মশলা কসাতে সক্ষম হবেন, ঠিক ততোটাই স্বাদ বৃদ্ধি পাবে। চাইলে আপনার তরকারীর সাথে কিছুটা মোটর শুটি যোগ করে নিতে পারেন।
মশলাটা ভালো ভাবে হয়ে এলে কিছুটা কাঁচা মরিচ যোগ করে দিয়ে,আরো ভালো ভাবে মশলা কষিয়ে নিন। কিছুটা পানি দিয়ে নাড়া চাড়া করতে থাকুন, অনেক বেশী নাড়বেন না।
এর পর তার ভেতরে বাধাকপি দিয়ে দিন। বাঁধাকপি নাড়াচাড়া করতে থাকুন। যদি চান তাহলে বাজারে রেডি মিক্স মশলা পাওয়া যায়, যোগ করে দিতে পারেন।
অল্প জল দিয়ে ঢেকে দিন। এর পর ৫ মিনিটের মতো অপেক্ষা করুন, যতোক্ষণ পর্যন্ত ভালো ভাবে সেদ্ধ না হয়ে আসে!
ব্যাস! সেদ্ধ হয়ে আসলে তৈরী হয়ে যাবে আপনার পছন্দের বাধাকপির তরকারী।গরম ধোয়া ওঠা ভাবের সাথে বাধাকপির তরকারী দিয়ে ভুড়ি ভোজ সেড়ে ফেলুন!
ডিম দিয়ে মজাদার বাঁধাকপি ভাজি
উপকরণ :
বাঁধাকপি, ডিম, লবণ, গোটা জিরা, বেশি করে পেয়াজ কুচি, কাঁচামরিচ ফালি ও তেল ।
প্রণালী:
- প্রথমে বাঁধাকপি কুচি করে কেটে গরম পানিতে ভাপে দিয়ে সিদ্ধ করে নিন ।
- তারপর ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে হাতে চিপে পানি সরিয়ে নিন ।
- এবার একটি কড়াইয়ে পরিমান মত তেলে পেয়াজ , কাঁচামরিচ ও গোটা জিরা ফোড়ন, স্বাদমতো লবণ নাড়তে থাকুন ।
- এরপর কড়াইয়ের ডিম হালকা ভাজা ভাজা হলে, বাঁধাকপি ঢেলে নাড়তে থাকুন।
- বাঁধাকপি ভাজা হলে চুলা থেকে নামিয়ে ইচ্ছামতো সাজিয়ে রুটি অথবা ভাতের সাথে পরিবেশন করুন।
বাঁধাকপি দিয়ে মুরগি
উপকরণ:
- দেশি মুরগি ১টি,
- পেঁয়াজ কুচি ১ কাপ,
- বাঁধাকপি ২ কাপ (বড় করে কাটা)
- রসুন বাটা ১ চা-চামচ,
- আদা বাটা ১ চা-চামচ,
- হলুদের গুঁড়া পরিমাণমতো,
- মরিচের গুঁড়া পরিমাণমতো,
- জায়ফল জয়ত্রী বাটা আধা চা-চামচ,
- ধনে বাটা ১ চা-চামচ,
- আস্ত গরমমসলা ও জিরা টেলে গুঁড়া করা আধা চা-চামচ,
- তেজপাতা ২টি,
- আস্ত দারুচিনি ২ টুকরা,
- আস্ত এলাচি ৪-৫টি।
- বাধাঁকপি দিয়ে মুরগির রেসিপি প্রস্তুত প্রণালি:
- মুরগি ভালো করে ধুয়ে নিন। এবার লবণ, আদা, রসুন বাটা দিয়ে ৩০ মিনিট ম্যারিনেট করে রাখুন।
- প্রথমে কড়াইতে তেল দিয়ে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে বাদামি করে ভাজতে হবে। এরপর এতে আদা বাটা, রসুন বাটা দিয়ে ভালো করে কষান।
- কষানো শেষে একে একে ধনে বাটা, হলুদের গুঁড়া, মরিচের গুঁড়া, আস্ত গরমমসলা, তেজপাতা, লবণ দিয়ে ভালো ভাবে নাড়তে থাকুন। এরপর কড়াইয়ের মশলা মিশ্রণে পরিমাণমতো পানি দিয়ে দিন।
- এরপর কষানো মসলা থেকে তেল ছাড়লে ম্যারিনেট করা মাংস এতে ছেড়ে দিন। ভালো করে নাড়তে থাকুন সাথে জায়ফল জয়ত্রী বাটা দিতে পারেন, তবে না দিলেও চলবে।
- মাংস সেদ্ধ হয়ে এলে শেষে বাঁধাকপির টুকরো দিন। প্যানে বা কড়াইতে বাঁধাকপি দিয়ে অল্প আঁচে ঢেকে রাখুন।
- ৫-১০ মিনিট পরে জিরা, গরমমসলার গুঁড়া উপরে ছড়িয়ে দিন। এরপর একটু ঘি দিয়ে নামিয়ে ফেলুন। আপনার মজাদার বাঁধাকপি দিয়ে মুরগির তরকারি প্রস্তুত!
বাঁধাকপির সালাদ
উপকরণ:
বাঁধাকপি-কুচি ২ কাপ।
পেঁয়াজ-কুচি ২টি।
শুকনা মরিচ ৩টি।
ধনেপাতা-কুচি ১ টেবিল-চামচ।
সরিষার তেল আধা চা-চামচ।
লবণ স্বাদ মতো।
বাধাঁকপির সালাদ তৈরির পদ্ধতি:
- বাঁধাকপি ধুয়ে কুচি কুচি করে কাটুন। শুকনা-মরিচ এবং সামান্য তেলে ভেজে নিন।
- পরিমাণমতো পেঁয়াজ, শুকনামরিচ, লবণ, ধনেপাতা-কুচি সরিষার তেল দিয়ে মাখাতে হবে।
- তারপর এই মশলার মিশ্রণের সঙ্গে বাঁধাকপি-কুচি ভালো ভাবে মাখালেই তৈরি হয়ে যাবে আপনার মুখরোচক সালাদ।
- চাইলে একটা টমেটো কুচিও যোগ করতে পারেন।
সতর্কতা
রান্নার প্রথমে আপনার একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, ভালো খাবার তৈরি করার জন্য তাজা এবং ফ্রেশ উপাদান দরকার। কারণ শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেম ঠিক রাখতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে নিরাপদ খাবারের বিকল্প নেই। ভেজাল উপকরণ দিয়ে তৈরি খাবার খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তো বাড়বেই না; বরং শরীর রোগের স্বর্গ রাজ্য হয়ে যাবে।
শেষ কথ
আজকের বাঁধাকপির তরকারি বিষয়ক ব্লগ এ পর্যন্তই! ভালো থাকবেন-আল্লাহ হাফেজ!